চীন ভ্রমণের ডায়েরী-প্রথম পর্ব
"স্বপ্নের দেশ চীন ভ্রমণ"
দিদারুল ইকবাল
সন্দ্বীপ দর্পন-এর প্রিয় পাঠক, বাংলাদেশ বেতার ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বেতারের শ্রোতা, ডিএক্সার বন্ধুরা এবং এই পত্রিকার সাথে সংশ্লিষ্ট সকলকে আমার আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। সেই সাথে ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি এই পত্রিকার সম্পাদক ও শ্রদ্ধাভাজন শাহাদাৎ হোসেন আশরাফ ভাইকে, যিনি তার পত্রিকায় আমার চীন ভ্রমণের ধারাবাহিক ডায়েরী প্রকাশ করার উদ্যোগ নিয়েছেন।
প্রিয় সুধী, আমি আপনাদের বন্ধু সিআরআই- সাউথ এশিয়া রেডিও ক্লাবের
প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, চীন আন্তর্জাতিক বেতার (সিআরআই)’র বাংলাদেশ মনিটর এবং সন্দ্বীপ দর্পন-এর ঢাকা ব্যুরো
প্রধান দিদারুল ইকবাল।
গত ৮ থেকে ১৬ই ডিসেম্বর ২০১২ পর্যন্ত আমি স্বপ্নের দেশ চীন ভ্রমন করেছি- চীন
আন্তর্জাতিক বেতার (সিআরআই) কর্তৃক আয়োজিত “হাইনান
আন্তর্জাতিক পর্যটন দ্বীপ” প্রতিযোগিতার ইন্টারন্যাশনাল
গ্র্যান্ড প্রাইজ উইনার বা আন্তর্জাতিক অভিজাত শ্রেণীর পুরস্কর বিজয়ী হিসেবে।
বাংলাদেশ থেকে আমি এবং আরো ৫টি দেশের (ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলংকা এবং
দক্ষিণ কোরিয়া) ৬ জন পুরস্কার বিজয়ী শ্রোতা একই সময়ে চীন ভ্রমণ করেছি।
চীন আন্তর্জাতিক বেতার (সিআরআই) বাংলা বিভাগ থেকে “হাইনান
আন্তর্জাতিক পর্যটন দ্বীপ” প্রতিযোগিতার গ্র্যান্ড পুরস্কার
বিজয়ী হিসেবে নির্বাচিত করায় আমি উক্ত বিভাগের পরিচালক মাদাম ইউকোয়াং য়ূএ, শ্রোতা
সম্পর্ক বিভাগের ছাই ইউয়ে (মুক্তা) সহ সকল কর্মী এবং সিআরআই’র উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের কাছে আমাদের ক্লাবের পক্ষ থেকে আন্তরিক
ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
ফিরে দেখা প্রতিযোগিতার প্রেক্ষাপট এবং আন্তর্জাতিক অভিজাত শ্রেণীর পুরস্কার বিজয়ঃ
হাইনান প্রদেশ হচ্ছে চীনের সবচেয়ে দক্ষিণ সীমানে অবস্থিত। এ প্রদেশ হচ্ছে
চীনের বৃহত্তম বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং একমাত্র গ্রীষ্মমন্ডলীয় দ্বীপ প্রদেশ। এ
প্রদেশ ‘প্রাচ্য হাওয়াই’ বলে খ্যাত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হাইনানের প্রাকৃতিক প্রাধান্যকে কাজে
লাগিয়ে চীন সরকার ‘হাইনান আন্তর্জাতিক পর্যটন দ্বীপ’ উন্নয়নের কৌশল উথ্থাপন করেছে এবং লক্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছ। হাইনান
প্রদেশ “আন্তর্জাতিক পর্যটন দ্বীপের উন্নয়ন কৌশল ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে রাষ্ট্রীয়
পরিষদের অনুমোদন পায়। এর জন্য চীন সরকার ধারাবাহিক সুবিধা-নীতি কার্যকর করে। এ
নীতিগুলো হাইনান দ্বীপের উন্নয়নে বড় ভূমিকা পালন করেছে”।
কেন্দ্রীয় সরকারের ধারাবাহিক সুবিধা-নীতিগুলোর মধ্যে দ্বীপ শুল্কনীতি সবচেয়ে
আকর্ষণীয়। এখন হাইনান প্রদেশের হাইখো ও সানইয়া শহরে শুল্কমুক্ত দোকান প্রতিষ্ঠিত
হয়েছে। প্রায় ৭ হাজার বর্গমিটার আয়তনের সানইয়া শহরের শুল্কমুক্ত দোকানে পারফিউম,
অলংকার, ঘড়ি ও চামড়া পণ্যসহ কয়েক ডজন ধরনের ২০ হাজারেরও বেশি পণ্য বিক্রি হয়। এ
শুল্কমুক্ত দোকানে প্রায় একশ’টি বিলাসবহুল দ্রব্যের
ব্র্যান্ড আছে। এসব পণ্যের দাম চীনের অভ্যন্তরীণ বিভাগীয় বিপণির চেয়ে ১৫ থেকে ৩০
শতাংশ কম। সুবিধা-নীতিগুলো হাইনানের আন্তর্জাতিক পর্যটন দ্বীপের উন্নয়ন কৌশল বাস্তবায়নের
ক্ষেত্রে খুব সহায়ক হয়েছে। এর পাশাপাশি হাইনান প্রদেশ নিজের সমৃদ্ধ পর্যটন সম্পদের
ভিত্তিতে ‘বিশ্বের প্রথম উপসাগর’
নামে পরিচিত ইয়ালোং উপসাগর আর উচি পাহাড়সহ কিছু চমৎকার পর্যটন স্থান প্রতিষ্ঠা
করেছে। তাছাড়া, হাইনান প্রদেশ পর্যটন সম্পদের প্রচারের মাত্রা বাড়িয়েছে। তারা
বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে নানা রকম আন্তর্জাতিক পর্যটনমেলা আর বিশেষ প্রচার
সভায় অংশগ্রহণ করে। চীনের বিভিন্ন প্রদেশ ও কেন্দ্রশাসিত মহানগরে গিয়ে নানা পর্যটনমেলায়
অংশগ্রহণ করে। তারা অনেক উচ্চ পর্যায়ের সম্মেলন, ফোরাম ও প্রদর্শনীর আয়োজন করে।
বিশেষ করে ভলভো নৌকা বাইচসহ নানা আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজনের মধ্য
দিয়ে হাইনান বিশ্ববিখ্যাত এক তারকা পর্যটন স্থানে পরিণত হয়েছে। পর্যটন শিল্প
উন্নয়নের উদ্দেশ্যে হাইনান প্রদেশ সংশ্লিষ্ট কর্মীদের প্রশিক্ষণের মাত্রা জোরদার
করেছে। ২০১১ সালে হাইনান প্রদেশ পল্লীপর্যটন, সমুদ্রপর্যটন, গলফপর্যটন, রেস্তোঁরা
ও দর্শনীয় স্থানের সেবকদের জন্য আট’টি প্রশিক্ষণ কোর্স
আয়োজন করে, ১১,৫০০ জন পথনির্দেশককে প্রশিক্ষণ দেয়। হাইনানের সেবাশিল্পে জড়িত ৯০.৭
শতাংশ কর্মী বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। হাইনান দ্বীপ তার বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সামুদ্রিক
দ্বীপের শৈলী দিয়ে দিন দিন আরো বেশি দেশি-বিদেশী পর্যটক আকর্ষণ করছে। পরিসংখ্যান
অনুযায়ী, ২০১১ সালে হাইনান প্রদেশ মোট ৩ কোটি ১০ হাজার পর্যটককে অভ্যর্থনা জানায়।
এর আগের বছরের তুলনায় এ সংখ্যা ১৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। পর্যটন শিল্পের মোট আয়
দাঁড়ায় ৩২.২ বিলিয়ন ইউয়ানে, যা এর আগের বছরের চেয়ে ২২ শতাংশ বেশি। হাইনানের সানইয়া
শহরের কানশিলিং হচ্ছে চীনের প্রাচীন লি ও মিয়াও জাতির সংস্কৃতি ও পর্যটন অঞ্চল,
এখানে চীনের সুদীর্ঘ বছরের ইতিহাস আছে। উম্মুক্ত নীতি, শ্রেষ্ঠ সম্পদ আর নিরলস
প্রচেষ্টার দ্বারা হাইনান আন্তর্জাতিক পর্যটন দ্বীপ নির্মাণের পথে বড় পদক্ষেপে
এগিয়ে যাচ্ছে।
হাইনান আন্তর্জাতিক পর্যটন দ্বীপ-এর এই অগ্রযাত্রা সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী
বেতার শ্রোতাদের কাছে আরো সহজভাবে তুলে ধরতে এবং শ্রোতাদের হাইনান দ্বীপের
আকর্ষণীয় পর্যটন অঞ্চল দেখাতে ও সুদীর্ঘ বছরের ইতিহাস জানাতে চীন আন্তর্জাতিক বেতার
(সিআরআই) একটি বিশেষ প্রতিযোগিতার আয়োজন করে।
৪ অক্টোবর ২০১২, চীন আন্তর্জাতিক বেতার (সিআরআই) তার বৈদেশিক বেতার
সম্প্রচার এবং তাদের অনলাইনে ঘোষণা করে অক্টোবর থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত বেতার ও
ওয়েবসাইটের মাধ্যমে “মনোহর নারিকেল দ্বীপ- হাইনান
আন্তর্জাতিক পর্যটন দ্বীপ” শীর্ষক একটি আন্তর্জাতিক
প্রতিযোগিতার আয়োজন করবে। যেখানে বিশ্বব্যাপী রেডিও শ্রোতাদের সক্রিয়ভাবে
প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। ঘোষনা করা হয় ঐ সময়ের মধ্যে
প্রতিযোগিতা সংশ্লিষ্ট চার’টি ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রচার
করা হবে। যারা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রতিযোগিতায় অংগ্রহণ করবে তাদের মধ্য থেকে
প্রতিযোগিতার মূল্যায়ন কমিটি প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীর পুরস্কার এবং
প্রতিযোগিতার মহামূল্যবান গ্র্যান্ড পুরস্কার বিজয়ী নির্বাচন করবেন। গ্র্যান্ড
পুরস্কার বিজয়ী ডিসেম্বর মাসে বিনা খরচে চীন সফরের সুযোগ পাবেন।
সিআরআই-এর ঘোষণা মোতাবেক অন্যান্য শ্রোতাদের মত আমিও এই প্রতিযোগিতায়
সাফল্যের সাথে অংশগ্রহণ করি এবং প্রতিযোগিতার মূল্যায়ন কমিটি আমাকে ইন্টারন্যাশনাল
গ্র্যান্ড প্রাইজ উইনার বা আন্তর্জাতিক অভিজাত শ্রেণীর পুরস্কার বিজয়ী হিসেবে
মনোনিত করেন। অভিনন্দনসহ এ সুসংবাদটি আমাকে দুপুর ২:৩০ মিনিটে সিআরআই স্টুডিও থেকে
ফোন (+৮৬১০৬৮৮৯১৫৬৪) করে জানান চীন আন্তর্জাতিক বেতার (সিআরআই) বাংলা বিভাগের চীনা
বিশেষজ্ঞ ছাই ইউয়ে (মুক্তা)। তখন আমি রাজধানী ঢাকার পুরানা পল্টন থেকে বাসে করে
বাসায় ফিরছিলাম এবং বাসটি জাতীয় স্কাউট ভবনের মোরে ছিলো। ফোনে মহা আনন্দের খবরটি
শুনে আমি প্রথমে বিশ্বাস-ই করতে পারিনি যে আমি সত্যি কানে ভালো ভাবে শুনেছি! তাই
আমি ঐ সময় আমার হাতে চিমটি কেটে দেখি আসলে আমি স্বপ্নের মধ্যে ছিলাম কিনা। ঐ মূহুর্তটি
ছিলো আমার কাছে একটি শ্রেষ্ঠ সময়, অবিশ্বাস্য, অসাধারণ এবং অপূর্ব। ফোনটি পেয়ে আমি
যেমন বিস্মিত, আনন্দিত এবং চমৎকৃত হয়েছি তেমনি গর্বিতও হয়েছি চীন আন্তর্জাতিক
বেতারের একজন একনিষ্ঠ শ্রোতা ও শ্রোতাসংগঠক হিসেবে। সিআরআই চীনা বিশেষজ্ঞ ছাই ইউয়ে
(মুক্তা)’র সাথে প্রয়োজনীয় কথা শেষ করে আমি
প্রথমে আনন্দের সংবাদটি জানায় আমার স্ত্রী ও রেডিও ডিএক্সার তাছলিমা আক্তার লিমা
এবং আমার মা আনোয়ারা বেগম-কে। এরপর পর্যায়্ক্রমে ক্লাবের নেতৃবৃন্দ, অন্যান্য
শ্রোতাসংগঠক ও ডিএক্সার বন্ধু এবং অফিস সহকর্মীদের ফোন করে জানায়। তখন খুশির সংবাদ
শুনে আমার পরিবার, ক্লাবের নেতৃবৃন্দ ও আমার অফিস সহকর্মীদের মধ্যে আনন্দ ছড়িয়ে
পড়ে এবং সবার মাঝে মিষ্টি বিতরণ করা হয়। ঐ দিন ছাই ইউয়ে (মুক্তা) যখন আমাকে ফোন
করেছেন তখন জরুরী ভিত্তিতে আমাকে আমার পাসপোর্ট এর কপি, ছবি, ব্যক্তিগত পরিচিতি
এবং বিমান টিকেট কোন নামে বুকিং দেওয়া হবে তার তথ্য পাঠাতে বলেন। যেহেতু আমার সাথে
ল্যাপটপ এবং গ্রামীণফোনের ইন্টারনেট মডেম ছিলো তাই আমি তার দেওয়া নির্দেশনা
অনুযায়ী তাৎক্ষনিক বাসে বসে প্রয়োজনীয় তথ্যসহ ধন্যবাদ জানিয়ে একটি ই-মেইল পাঠিয়ে
দিই। এছাড়া সিআরআই বাংলা বিভাগের পরিচালক মাদাম ইউকোয়াং য়ূএ-কে ফোন করে ধন্যবাদ
জানাই ‘হাইনান আন্তর্জাতিক পর্যটন দ্বীপ’ প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশও বিজয়ী হওয়ায় এবং শ্রোতা হিসেবে আমাকে চীন
ভ্রমণের সুযোগ দেওয়ায়। মাদাম ইউকোয়াং য়ূএ-ও আমাকে অভিনন্দন জানান। পরবর্তিতে ছাই
ইউয়ে (মুক্তা) ই-মেইল করে আমার কাছে ‘China Invitation Letter of Duly
Authorized Unit’ এবং বিমানের ই-টিকেট পাঠান। এছাড়া ফিডেক্স এক্সপ্রেস
সার্ভিস এর মাধ্যমে মূল ‘ডিউলি অ্যথ্যারাইজড ইউনিট এর নিমন্ত্রণপত্র’ পাঠিয়ে দেন। ২০১২ সালের ২ ডিসেম্বর আমি বাংলাদেশস্থ চীনা দূতাবাসে
ভিসা’র জন্য আবেদন করি। সিআরআই বাংলা বিভাগের সাবেক বিদেশী বিশেষজ্ঞ এবং
সিআরআই-এসএমএফ কনফুসিয়াস ক্লাসরুমের কনসালটেন্ট শিক্ষক মহিউদ্দীন তাহের ভাই আমার
ভিসা দ্রুত পাওয়ার জন্য সহযোগিতা করতে চীনা দূতাবাসের মাননীয় সাংস্কৃতিক
কাউন্সেলরের স্ত্রী মিসেস শুওয়েই-কে ফোন করে অনুরোধ করেন। তখন তিনি আমার ভিসা
আবেদনের যাবতীয় কাজগপত্র (ভিসা ফরওয়ার্ডিং লেটার, ভিসা আবেদনের পুরনকৃত ফরম, ছবি, Duly
Authorized Unit এর নিমন্ত্রণপত্র, বিমান টিকেট, পাসপোর্টের
ফটোকপি এবং ব্যাংক স্টেইটম্যান্ট) যাচাই করে দেখেন এবং আমাকে দূতাবাসে বসিয়ে রেখে
ভিসা সার্ভিস সেকশন থেকে ভিসা আবেদনের সকল প্রক্রিয়া নিজেই সম্পন্ন করে দেন। ঐসময়
আমি চীনা দূতাবাস থেকে ছাই ইউয়ে (মুক্তা)’র কাছে ফোন করি
এবং তিনি সাংস্কৃতিক কাউন্সেলরের স্ত্রী শুওয়েই-এর সাথে বিস্তারিত কথা বলেন এবং
সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। আমি ও তাকে ধন্যবাদ জানায়। ৬ ডিসেম্বর আমি
চীন ভ্রমণের ভিসা পায় (ভিসা নং-জি৩১৭০৩৫৪)।
চীনে যাত্রা শুরুঃ
২০১২ সালের ৮ ডিসেম্বর শনিবার, আমি বাংলাদেশ সময় দুপুর ৩:৩০ মিনিটে চীনের
উদ্দেশ্যে ঢাকা হযরত শাহজালাল (রা:) আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে চায়না ইস্টার্ণ
এয়ারলাইন্সের এম.ইউ ২০৩৬ ফ্লাইটে রওনা হয়। ঐদিন বিমান বন্দরে আমাকে ভ্রমণের
উদ্দেশ্যে বিদায় জানাতে এসেছিলেন বিশিষ্ট বেতার সংগঠক, সিআরআই লিসনার্স ক্লাব অব
বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এবং চীন আন্তর্জাতিক বেতার বাংলা বিভাগের প্রথম বাংলাদেশ
প্রতিনিধি সৈয়দ রেজাউল করিম বেলাল, রেডিও ডিএক্সার এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের
ন্যাশনাল কো-অর্ডিনেটর মো: মাহাবুবুর রহমান, দুরন্ত রেডিও ফ্যান ক্লাবের সভাপতি
ডিএক্সার তাছলিমা আক্তার লিমা, সাধারণ সম্পাদক মো: রফিকুল ইসলাম, সদস্য হাজেরা
বেগম, ডিএক্সার শাহীন পাটোয়ারী, মো: সোহেল রানা হৃদয়, মো: জাকারিয়া, আরশাদ সোহেলসহ
আরো অনেকে। এছাড়া ফোনে চীন ভ্রমণের শুভ কামনা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন, বাংলাদেশ-চীন
গণমৈত্রী সমিতির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মো: বশিরউল্লাহ, বাংলাদেশ বেতার রিসার্স
এন্ড রিসিভিং সেন্টারের সিনিয়র প্রকৌশলী এটিএম জিয়া হাসান, বাংলাদেশ বেতার
কুমিল্লার সিনিয়র আঞ্চলিক প্রকৌশলী আবু তাহের রায়হান, এবিসি (এফএম) রেডিও থেকে মো:
মিরাজ হোসাইন, সিআরআই লিসনার্স ক্লাব অব বাংলাদেশের ভাইস চেয়ারম্যান ওসমান গণী,
গাজীপুর রেমাশ আন্তর্জাতিক বেতার শ্রোতাসংঘের সভাপতি মো: শহীদুল কায়সার লিমন,
রাজবাড়ী থেকে শ্রোতাবন্ধু সুমী খান, কবির ইসলাম মিঠু, ফাতেমা বেগম, কুষ্টিয়া থেকে
সিআরআই ক্লাব’৯৫ এর সভাপতি বিপ্লব কুমার অধিকারি,
লিলিমা বেগম, চট্রগ্রাম থেকে সন্দ্বীপ দর্পন-এর সম্পাদক শাহাদাৎ হোসেন আশরাফ,
সিআরআই- সাউথ এশিয়া রেডিও ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক কালাম উল্লাহ সুমন, অর্থ সম্পাদক
মো: নুরুল ইসলাম মেরাজ, মিডিয়া সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল নোমান, চট্রগ্রামের মাসিক
বিশ্ববন্ধন পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক নূর মোহাম্মদ, আমার প্রিয় মা আনোয়ারা বেগম,
ছোট বোন তাছলিমা বেগম, মুছলিমা বেগম, জোবেদা রিনা, উম্মে সালমা মাছুমা,
চট্রগ্রামের শ্রোতাবন্ধু ও সাংবাদিক মেহেদী হাসান, সাতক্ষীরা থেকে ছোট খালু
(আঙ্কেল) সিরাজুল ইসলাম, ঠাকুরগাঁও থেকে ছোট খালা আবেদা সুলতানা রুবিনা ও তার
পরিবার, বাহারাইন (মধ্যপ্রাচ্য) থেকে শাওন খান সহ আরো অনেকে।
এছাড়াও মোবাইল ম্যাসেজ এবং ফেইসবুকে অভিনন্দনবার্তা পাঠিয়েছেন, অতিরিক্ত
সচিব এবং বাংলাদেশ বেতারের মহাপরিচালক কাজী আক্তার উদ্দিন আহমেদ, রেডিও রিপাবলিক অব
ইন্দোনেশিয়া (আরআরআই) ওয়ার্ল্ড সার্ভিস-ভয়েস অব ইন্দোনেশিয়া (ভিওআই)’র পরিচালক কাবুল বুদিয়ানো, ব্রডকাস্ট কো-অপারেশন
কো-অর্ডিনেটর রিতা আসমারা, ওয়াতি ইল আব্দুররহমান,এন্ড্রি, সিআরআই বাংলাদেশ মনিটর(২)
প্রফেসর আশরাফুল ইসলাম, ফরিদপুর থেকে আফজাল আলী খান, জয়পুরহাট থেকে নুরুজ্জামান
ইসলাম মাদু, যশোর থেকে নুরআলম, রাজবাড়ী থেকে বাদন রুদ্র, খুলনা থেকে পলাশ বিশ্বাস,
জামালপুর থেকে সবুজ মাহমুদ সহ আরো অনেক শ্রোতাবন্ধু। সবার নাম এখানে উল্লেখ করতে
পারিনি বলে আমি আন্তরিক ভাবে দুঃক্ষিত। তবে আমি সবার কাছে আন্তরিক ভাবে কৃতজ্ঞ। এছাড়া
আমি বিশেষ ভাবে ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি গাজীপুর রেমাশ আন্তর্জাতিক বেতার শ্রোতাসংঘের
সভাপতি এবং রেডিও ডিএক্সার এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের মো: শহীদুল কায়সার লিমন-কে।
যিনি আমার চীন ভ্রমণের সময় বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের বাহিরে অবস্থিত শ্রোতা,
ডিএক্সার, বিভিন্ন বেতারের কর্মকর্তা, মিডিয়া ও মিডিয়াকর্মীদের বিশেষ মোবাইল
এসএমএস বার্তা পাঠিয়েছিলেন এবং সামাজিক যোগাযোগ সাইট ফেইসবুক ও মাইক্রোব্লগিং সাইট
টুইটারে স্ট্যাটার্স দিয়েছিলেন। ভ্রমণের দিন দুপুর প্রায় ১২টায় আমাকে বিদায় জানাতে
আসা চীন আন্তর্জাতিক বেতারের শ্রোতাসংঘের নেতৃবৃন্দ এবং শ্রোতাবন্ধুদের সাথে হযরত
শাহজালাল (রাঃ) আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের বহির্গমন ২নং টার্মিনালে মিলিত হই।
এখানে আমরা বেশ কিছুক্ষণ সিআরআই এর বিভিন্ন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করি এবং
সিআরআই’র জন্য শ্রোতাদের দেওয়া কিছু মূল্যবান প্রস্তাব
নোট করে রাখি সিআরআই বাংলা বিভাগের কর্তৃপক্ষকে দেওয়ার জন্য। এরপর সবাই মিলে বেশ
কিছু গ্রুপ ছবি তুলি ভ্রমণের মুহুর্তগুলিকে স্বরণীয় করে রাখতে। দুপুর প্রায় ১:২০
মিনিটে আমি সবাইকে আনুষ্ঠানিক বিদায় জানিয়ে বিমান বন্দরের বহির্গমন চেক-ইন এ
প্রবেশ করি। এরপর বোর্ডিং পাস সার্ভিস কাউন্টার থেকে চায়না ইস্টার্ণ এয়ারলাইন্সের
এম.ইউ ২০৩৬ ফ্লাইটের বোর্ডিং কার্ড বা চীনা বিমানে আরোহণের অনুমতিপত্র সংগ্রহ
(ই-টিকেট নং-৭৮১২৬৪১৬২৩৭৬৯সি১), বহির্গমন কার্ড পুরন, ইন্টারন্যাশনাল ইমিগ্রেশন
সার্ভিস (পাসপোর্ট ও ভিসায় সিলমোহর সহ অন্যান্য) সম্পন্ন করে বহির্গমন লাউঞ্জে
অপেক্ষা করতে থাকি। আমার ফ্লাইট দুপুর ২:১০ মিনিটে ছাড়ার কথা থাকলেও সেটি কিছুটা
বিলম্বিত হয়। এরপর চূড়ান্ত নিরাপত্তা চেক সম্পন্ন করে বোর্ডিং রুমে প্রবেশ করি।
বেলা ৩:০০টায় বোর্ডিং গেইট খোলা হয়। বিমানটি বোর্ডিং ব্রীজে না থাকায় আমরা
টারমার্ক থেকে বিমানে উঠি। এসময় বিমানের দরজায় দাড়িয়ে দু’জন
বিমান বালা চীনা ভাষায় স্বাগত জানান। আসনগ্রহণ শেষে যাত্রীদের নিরাপত্তা নির্দেশনা
প্রদান করেন একজন প্রশিক্ষিত কেবিন ক্রু। ৩:৩০ মিনিটে ফ্লাইটটি প্রথম গন্তব্যস্থল
চীনের প্রবেশদ্বার কুনমিং আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের উদ্দেশ্যে ঢাকা থেকে উড্ডয়ন
করে।
বিমানে আমার আসনটি জানালার পাশে থাকায় আকাশ থেকে উপভোগ করেছিলেম ঢাকাসহ আশে
পাশের শহর এবং আকাশে মেঘের বৈচিত্র। ৪:১৫ মিনিটে বিমাদের স্মার্ট কেবিন ক্রুবৃন্দ
(এয়ার স্টুয়ার্ড ও এয়ার হোস্টেজ) ‘ফ্লাইং
মিল’ বা বেশ কিছু সুস্বাধু খাবার সরবরাহ করেন। তৃপ্তী
সহকারে খেলাম । তৃপ্তী সহকারে খেলাম। এরপর আবার শুরু হলো জানালা দিয়ে সৃষ্টির সৌন্দর্য
উপভোগ করা। বাংলাদেশ এবং চীনের মধ্যে সময়ের পার্থক্য ২ ঘন্টার। দিনের আলোয় আকাশের
লাল-নীল রঙের খেলা, মেঘের পাহাড়, নিচের পৃথিবীতে পাহাড়-পর্বত, নদী-সমুদ্র আরো কতো কী
দেখেছি। পড়ন্ত বিকেলে মাঝে মধ্যে সূর্যের মিষ্টি রোধ বিমানের জানালা বেধ করে রঙিন
আলো/সৌরভ ছড়াচ্ছিলো আমার মনে। আমি যেন বার বার মনের অজান্তে হারিয়ে গেছি কল্পনার
স্বর্গরাজ্যে। প্রতিটি মূহুর্তে অনুভব করেছি মহান সৃষ্টিকর্তাকে এবং তার সৃষ্টির অপরূপ
সৌন্দর্যকে। যিনি অপরূপ রূপে সাজিয়েছেন এ আকাশ ও ভূ-মন্ডল। বিমানের যাত্রীদের
বিনোদনের জন্য নানা উপকরণ (টেলিভিশন, ভিডিও ছবি, গান শুনা, ডিজিটাল বই পড়া এবং
ভিডিও গেমস খেলা) থাকলেও সেগুলির প্রতি আমার বিন্দুমাত্র আকর্ষণ ছিলোনা। বেশিরভাগ
যাত্রী মেতে ছিলেন ভিডিও ছবি দেখা অথবা কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনা কিংবা ভিডিও
গেমস খেলার মধ্যে। কিন্তু আমি ছিলাম ভিন্ন। বিমানে জানালার বাহিরে যা কিছু আমাকে
আকর্ষণ করেছে তা আমি ক্লিক ক্লিক ক্লিক ফ্ল্যাশের মাধ্যমে ক্যামেরার ফ্রেমে বন্দি
করেছি। বাংলাদেশ সময় ৫:৪৫ মিনিট হলেও সময়ের ব্যবধানের কারনে চীনে তখন রাত, আর এ
সময় আমাদের বিমানটি চীনের কুনমিং আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে অর্থাৎ তার গন্তব্যে
অবতরণ করে। কুনমিং-কে বলা হয় চীনের প্রবেশদ্বার অর্থাৎ যারা চীনে ভ্রমণ করেন তাদের
পাসপোর্ট এবং ভিসায় এখানে ইমিগ্রেশন সার্ভিসে চীনে প্রবেশের সিলমোহর করা হয়। ঢাকা
বিমান বন্দরে বোর্ডিং এর সময় আমি পরিচিত হয়েছিলাম ৩ জন বাংলাদেশীর সাথে, তাদের
একজন হলেন- জাপানের বাংলাদেশ কমিউনিটি ইন ফুকুকা’র কনভেনার ড. এ.টি.এম.শরিফুল
ইসলাম (এমবিবিএস, পিএইচডি); জাপান কাগুসিমা ইউনির্ভাসিটির ফিশারিজ ডিপার্টমেন্টের
এসেসটেন্ট প্রফেসর মো: আব্দুল কাদের (পিএইচডি) এবং মি. ওয়াকার, যিনি কানাডায় একটি
বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। আমরা ৪ জন-ই প্রথমে বেইজিং-এ যায় পরে ৩ জন চলে যান
জাপান এবং কানাডায়।
যাই হোক বিমান থেকে বের হয়ে আমরা চারজন ট্রানজিট স্টেশন কুনমিং বিমান
বন্দরের ইমিগ্রেশন সার্ভিস কাউন্টারে যায়। সেখান থেকে বেইজিং গমনকারী প্রত্যেকের
পাসপোর্ট, ভিসা চেক করে সিলমোহর করা হয়। ইমিগ্রেশন সার্ভিস কাউন্টারে আমি কিছুটা
বিরম্বনায় পরি আমার পাসপোর্টের কারনে, কারন আমার পাসপোর্ট ছিল অ্যানালগ! মেশিন
রিডেবল পাসপোর্ট না হওয়ায় ইমিগ্রেশন পুলিশ সেটা বার-বার ঘষামাজা করে পরীক্ষা করে
দেখলো আসল কিনা! এমনকি পাশের ডেস্কের অন্য একজন পুলিশকে দিয়েও চেক করালো। অনেকটা
আমরা ৫০০ কিংবা ১০০০ টাকার নোট যেভাবে পরীক্ষা করে থাকি জাল নোট কিনা! যদিও আমার
পাসপোর্টে অন্যদেশের আরো ভিসা ছিলো। যাইহোক ‘সঠিক’ নিশ্চিন্ত হওয়ার পর আমার
পাসপোর্টের ভিসায় সিলমোহর করে ৬:১৫ মিনিটে। ইমিগ্রেশন চেক-আউট শেষে একজন এয়ারপোর্ট
সিকিউরিটি বেইজিংগামী যাত্রীদের আলাদা করে ২০নং গেইটে জড়ো করে বোর্ডিং পাস প্রদান
করলেন। এই ফাঁকে কুনমিং টার্মিনালের অভ্যন্তরে আমরা ৪ জন কয়েকটি ছবি তুলি। কুনমিং
বিমান বন্দরটি অনেক বড়, খোলামেলা, অত্যাধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর, সুরক্ষিত,
সুশৃঙ্খল, সুসজ্জিত ও পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। কয়েক মিনিট পর সিকিউরিটি গাইডকে অনুসরণ
করে ৬:৩০ মিনিটে আমরা বোর্ডিং ব্রীজ দিয়ে পুন:রায় একই বিমানে উঠি। বিমান ছাড়ার পর
৭:২০ মিনিটে ফ্লাইট কর্তৃপক্ষ রাতের খাবার সরবরাহ করে। আমি পূর্বের মত কুনমিং থেকে
বেইজিং অবতরনের আগ পর্যন্ত রাতে নিচের পৃথিবী দেখার চেষ্টা করি। আর আমার আসনের
সামনে (ইন্ডিভিজ্যুয়াল) টিভি স্ক্রিনে মাঝে মধ্যে ফ্লাইট ইনফরমেশন গাইডে আর্থ
ম্যাপে ট্রেকিং করে দেখছিলাম আমরা যে বিমানে রয়েছি সেটি কোন পথে যাচ্ছে, দূরত্ব
কত, কাছাকাছি কোন কোন বিমান বন্দর রয়েছে, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কত ফীট উচ্চতায় রয়েছে,
গ্রাউন্ড স্পীড প্রতি ঘন্টায় কত মাইল, আউট সাইড এয়ার টেম্পারেচ্যার কত ফারেনহাইট,
গন্তব্যে পৌঁছানোর সময়, স্থানীয় সময় ইত্যাদি। আকাশ পথ থেকে বিমানটি যতই নিচের দিকে
নেমে আসছিলো ততই বেইজিংয়ের লাল-নীল বাতিগুলি ক্রমান্নয়ে আলোকিত করে তুলেছিলো
বেইজিং-কে। কারণ রাতের অন্ধকারে আকাশ থেকে নিচের পৃথিবীর জ্বল জ্বলে বিভিন্ন রঙিন
আলো মনোরম ও দৃষ্টিনন্দন দেখাচ্ছিলো। এক কথায় অপূর্ব!
বাংলাদেশ সময় রাত ৯:৫০ মিনিটে আমাদের বহনকারী চায়না ইস্টার্ণ এয়ারলাইন্সের
এম.ইউ ২০৩৬ ফ্লাইটটি চীনের রাজধানী ‘বেইজিং ক্যাপিটাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর’-এ
অবতরণ করে। আমি যখন বিমান থেকে নামি তখন বেইজিং এর তাপমাত্রা মাইনাস দশ ডিগ্রি
(-১০˚) সেলসিয়াস। এসময় মনে হয়েছে কেউ যেন আমার সমস্ত শরীরে মোটা মোটা কাঁটা বা
শুই দিয়ে পোড়াচ্ছে আর আমার মুখ ও ঠোঁট টান টান করে শুকিয়ে যেতে লাগলো। এর পূর্বে
আমি এত ঠান্ডার মোখমোখি আর কখনো হইনি। অনেক মোটা মোটা শীতের কাপড় পড়ার পরেও শীতের
তীব্রতা থেকে আমার শেষ রক্ষা হয়নি। মাইনাস শীতে এটি ছিলো আমার জন্য প্রথম
অভিজ্ঞতা। যদিও তীব্র শীতের প্রথম অনুভুতি কয়েক মিনিটের জন্য পেয়েছিলাম কুনমিং
বিমান বন্দরে বিমানে উঠার পূর্বে। বেইজিং-এ যেহেতু বিমানটি টারমার্কে তার যাত্রা
শেষ করে বা ল্যান্ড করে তখন সবাই বিমান থেকে বের হয়ে বিমান থেকে নির্দিষ্ট দূরত্বে
দাড়ানো এ্যারাইবেল বাসে দ্রুত দৌড়ে উঠতে লাগলেন। আমরাও নীচে নেমে আসলাম। আমি জাপান
কাগুসিমা ইউনির্ভাসিটির এসেসটেন্ট প্রফেসর মো: আব্দুল কাদের ভাইকে অনুরোধ করলাম
আমার ক্যামেরা দিয়ে টারমার্কে একটি ছবি তুলে দিতে। তিনি ক্লিক, ক্লিক, ক্লিক করে
৩টি ছবি তুলে দিলেন যখন, তখন সময় ১০:০৩ মিনিট। এরপর এ্যারাইবেল বাসে উঠলাম এবং
বাসটি আমাদেরকে ৩নং টার্মিনাল ভবনে নিয়ে গেলো। আমরা বাস থেকে নেমে পায়ে হেটে
টার্মিনাল ভবনের ভেতরে বিভিন্ন তলায় উপরে-নিচে সিড়ি বেয়ে এ্যারাইবেল লাউঞ্জে
প্রবেশ করলাম। যদিও আমি ইতিপূর্বে চীন ভ্রমণ করিনি। তাই প্রস্থানের পথ আমার জানা
ছিলোনা। ফলে আমি আমার স্বদেশীদের সাথে পথ অনুসরণ করেছি। রাত ১০:১৫ মিনিটে আমি আমার
লাগেজ সংগ্রহ করি। অন্যরাও লাগেজ সংগ্রহ করলেন এ্যারাইবেল লাগেজ বেল্ট থেকে। ১০:৩০
মিনিটে আমরা বের হলাম এবং আমি আমার চীনা বন্ধু সিআরআই বাংলা বিভাগের ছাই ইউয়ে
(মুক্তা)-কে খুঁজতে লাগলাম। বাইরে অপেক্ষমান অনেক লোক, তাদের স্বজন কিংবা
পরিচিতজনদের দ্রুত খুঁজে পেতে আগমনকারী ব্যক্তির নাম প্লেকার্ডে লিখে হাত উচিয়ে
ধরে রেখেছেন। প্রস্থান গেইট যেহেতু অনেকগুলি এবং অনেক লম্বা তাই আমি এক প্রান্ত
থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত প্রদর্শনকৃত প্লেকার্ড বা নামের ব্যানারগুলিতে আমার নাম
খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু খুঁজে পেলাম না। কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়লাম সিআরআই বন্ধু
মুক্তা’কে না পেয়ে। মনে মনে ভাবলাম হয়ত সে এখনো এসে পৌঁছায়নি। আর যেহেতু সে আমাকে
চেনে এবং আমিও তাকে চিনি তাহলে একে অপরকে খুজেঁ পেতে কোন সমস্যা হওয়ার কথা নয়। এসব
ভাবতে ভাবতে প্রায় ১০:৪০ মিনিটে ছাই ইউয়ে (মুক্তা) এসে উপস্থিত এবং দূর থেকে আমাকে
‘হায়! দিদারুল’ বলে জোরে ডাক দিলেন। আমিও হাত উচিয়ে তার ডাকে সারা দিলাম ‘হায়!
মুক্তা আপু’ বলে। উভয়ে করমর্দন করে কুশল বিনিময় করলাম। ছাই ইউয়ে (মুক্তা) আপু
ভ্রমণের কোন অসুবিধা হয়েছে কিনা জানতে চাইলেন এবং আমাকে অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে
চীনে উষ্ম স্বাগত জানালেন। এরপর আমি স্বদেশী অন্য ৩ জনের সাথে মুক্তা আপুকে পরিচয়
করিয়ে দিই। তাঁরা উভয়ে কুশল বিনিময় করলেন এবং ব্যক্তিগত পরিচয় জানালেন। সৌজন্য
বিদায়ের পর ছাই ইউয়ে (মুক্তা) আপু বিমান বন্দর থেকে আমাকে নিয়ে হোটেলে আসেন
বাংলাদেশ সময় রাত ১১:৩০ মিনিটে। আমার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে বেইজিং-এর চারতারকা
মানের হোটেল ‘নং-৯ ডিসাং রোড’-এ। হোটেলে প্রবেশের পর কনকনে শীতের হাত থেকে কিছুটা
মুক্তি পাই। এই হোটেলে আমি সহ আরো ৫টি দেশের পুরস্কার বিজয়ীদের থাকার জন্য পূর্ব
থেকে বুকিং দেওয়া ছিলো। হোটেলের রিসেপশনেও আমার পাসপোর্টের কারনে কিছুটা বিড়ম্বনার
শীকার হতে হয়েছে। ছাই ইউয়ে (মুক্তা) রিসেপশনিস্টদের এর কারণ বাখ্যা করেন এবং সৃষ্ট
সমস্যার সমাধান করেন। এ্যানালগ পাসপোর্ট নিয়ে বিড়ম্বনার আরো কথা আছে পরে লিখছি।
এরপর রিসেপশনে আনুষ্ঠানিক অফিসিয়াল ফরমালিটি শেষ করে মুক্তা আপু আমাকে আমার জন্য
বরাদ্ধকৃত ৯২৩ নম্বর রুমে নিয়ে গেলেন। রুমে এসে তিনি আমার স্ত্রী ডিএক্সার তাছলিমা
আক্তার লিমার জন্য একটি ক্রিস্টালের মূল্যবান উপহার দেন। আমি তা সম্মানের সাথে
গ্রহণ করি এবং ধন্যবাদ জানায়। চীনে অতিথি বা বন্ধুদের উপহার দেওয়া একটি প্রাচীন
রীতিনীতি বা বৈশিষ্ট। যে কোনো দেশেই হোক যখন অন্যের কাছ থেকে কেউ উপহার পায়, তখন
সবাই ‘ধন্যবাদ’ বলার সঙ্গে সঙ্গে হাসি মুখ দেখায়। চীনা মানুষেরা যখন উপহার পায়,
সাধারণত প্রথমে ‘না না, আমি নিতে পারি না’ এমন কথা বলে। আসলে তা এক রকম শিষ্ট
বাক্য। যারা বা যিনি উপহার দিয়েছেন, তাদের সামনে চীনা মানুষ উপহার খুলেন না। চীনের
রীতিনীতি অনুযায়ী কেবল মূল্যবান উপহার দেয়া হয়। তার মাধ্যমে নিজের আন্তরিকতা
প্রকাশ করা হয়। তাই চীনা মানুষেরা সাধারণত বন্ধুকে দামী উপহার দেন।
এছাড়া ছাই ইউয়ে (মুক্তা) আপু রাতে খাবার জন্য জুস, চকলেট, বিস্কিটসহ নানা
রকম খাবার নিয়ে আসেন। যদিও আমি বিমানে খেয়েছি এবং কোন ক্ষুধা নেই। যাইহোক আমাকে
পরদিনের কর্মসূচী সম্পর্কে বিস্তারিত নোট দিয়ে তিনি বিদায় নিয়ে তার বাসায় চলে
গেলেন। আমি যে হোটেলে ছিলাম সেখান থেকে তার বাসার দূরত্ব সামান্য। বন্ধু মুক্তা
যখন আমাকে বিমান বন্দর থেকে তার নিজের গাড়ীতে করে হোটেলে নিয়ে আসছিলেন তখন পথে
বাসাটি দেখিয়েছিলেন। অবশ্য বাসায় যাওয়ার দাওয়াতও দিয়েছিলেন, কিন্তু সময় না থাকার
কারনে যাওয়া হয়নি। রাতের বেশির ভাগ সময় জেগে আমি পরদিনের ভ্রমণ কর্মসূচীর যাবতীয়
প্রস্তুতি শেষ করে ঘুমিয়ে পরলাম। যাতে সকালে তাড়াহুড়া করতে না হয়। কারণ, চীনে সবাই
সময়ের যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করে। আর এভাবেই আমার চীন ভ্রমণের প্রথম পর্যায় শুরু
হলো।
০৭-০৪-২০১৩ খ্রি:
(দিদারুল ইকবাল)
আন্তর্জাতিক গ্র্যান্ড পুরস্কার বিজয়ী
হাইনান আন্তর্জাতিক পর্যটন দ্বীপ প্রতিযোগিতা ২০১২
চীন আন্তর্জাতিক বেতার (সিআরআই)
[বি.দ্র: এই ভ্রমণ ডায়েরীটি চট্টগ্রাম থেকে
প্রকাশিত মাসিক ‘সন্দ্বীপ দর্পন’ এর মার্চ-এপ্রিল ২০১৩ সংখ্যার ৮ম পৃষ্ঠায় ছাপানো
হয়েছে।]
No comments:
Post a Comment