চীন আন্তর্জাতিক বেতার বাংলা বিভাগের ৫০ বছর পূর্তি
সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে বিশেষ স্মৃতিচারণ
চীনা রেডিও শুনতে শুনতে এই সুন্দর অজানা দেশে যাওয়ার একটি সুযোগ ভাগ্যে আসে একদিন। যা কখনো কল্পনা করিনি। আমার সৌভাগ্য যে সত্যি সত্যি আমি চীন দেশে পৌঁছে যাই। তবে এর জন্য একটু কষ্ট করতে হয়েছে বৈকি। যেমন চীনা দূতাবাসে গিয়ে ভিসার জন্য ৩ দিন লাইনে দাড়িয়ে ছিলাম। যাই হোক চীনে গিয়ে সে কষ্ট আমার দূর হয়েছে। চীন দেশে গিয়ে বিভিন্ন স্থান দর্শন করেছি, মজার মজার খাবার খেয়েছি আর ছবি তুলেছি। এর মধ্যে আমার কাছে সবচেয়ে ভালো লেগেছে Provident City বা নিশিদ্ধ নগরী এবং Great
Wall বা মাহাপ্রচীর। নিশিদ্ধ নগরী নামটি শুনতেই যেন একটু অন্যরকম অদ্ভুদ লাগে। সেখানে যাওয়ার আকুল আবেগ কাজ করে নিশিদ্ধ নামটি কেন? আসলে সেখানে গেলেই সব বোঝা যায়। ফরবিডেন সিটি পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর একটি স্থাপনা। ১৯৮৭ সালে ইউনেস্কো এটিকে বিশ্বে কাঠের সবচেয়ে বড় সংগ্রহ হিসেবে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের অন্তর্গত হিসেবে ঘোষণা করে। ৭৮ লাখ বর্ঘফুট এলাকা জুড়ে নির্মিত প্রাচীর ঘেরা এই বিশার জগতের মধ্যে রয়েছে ৯৮০টি প্রসাদ, বাগান, ভাস্কর্য, জলাশয় ও প্রাঙ্গণ। Provident City ছিল চীন সম্রাটদের বাসস্থান এবং পাঁচশ’ বছর ধরে চীনের প্রশাসনিক ক্ষমতার মূল কেন্দ্র। চীনের ইউয়ান রাজবংশের সময় Provident City-র ভিত্তি প্রস্তর স্থাপিত হলেও এর মূল স্থাপনাগুলো গড়ে ওঠে মিং ও ছিং রাজবংশের শাসনকালে। সম্রাটের অনুমতি ছাড়া এ এলাকায় কেউ প্রবেশ করতে বা এলাকা ত্যাগ করতে পারতো না বলে এর নাম Provident City। মিং রাজবংশের ১৪ জন সম্রাট এবং ছিং রাজবংশের ১০ জন সম্রাট Provident City-তে বাস করেন এবং এখান থেকে পুরো চীন দেশ শাসন করেন। এখানে রয়েছে প্যালেস মিউজিয়াম। মিউজিয়ামে রয়েছে মিং রাজবংশের সময় নির্মিত চীনা মাটির অপূর্ব সুন্দর শিল্প নিদর্শন, সোনা, রূপা, জেড পাথর সহ বিভিন্ন মহামূল্যবান রত্নে তৈরী শিল্প সামগ্রী, চীনা রেশমের কারুকার্যময় পোশাক, দূর্লভ হস্তশিল্প। এছাড়া রয়েছে তাং ও সং রাজবংশের অসাধারণ মূল্যবান শিল্প সংগ্রহ এবং ৫০ হাজার পেইন্টিং।
প্রাসাদের হলরুম গুলিও দেখার মত। সিংহাসন, মেঝে, দেয়াল ও সিলিংয়ের অপূর্ব কারুকার্য আমাকে বিস্মিত ও মুগ্ধ করে। শুনেছি এখানে নাকি সম্রাটের অভিষেক অনুষ্ঠান অথবা রাজপরিবারের বিয়ে কিংবা বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। তিনটি হলে সিংহাসন থাকলেও সবচেয়ে জমকালো সিংহাসনটি রয়েছে সুপ্রিম হারমোনি হলে।
মিং ও ছিং রাজবংশের সম্রাট ও তার পরিবারের বাসস্থান অন্দর দরবারের প্রাসাদগুলোর নান্দনিক কারুকার্য দেখে আমি বিস্মিত হয়ে অনুভব করেছি চীনের সম্রাটদের ঐশ্বর্য ও শিল্পীদের অসাধারণ নৈপুণ্যকে। চীনের রাজধানী বেইজিংয়ের প্রাণকেন্দ্রে থিয়েন আনমেন স্কয়ারের বিপরীতে অবস্থিত প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় চীনা সভ্যতার শিল্পকীর্তির প্রতীক, শিল্প, বিলাস ও সৌন্দর্যের এই অপূর্ব নিদর্শন Provident City আমার দেখা সম্ভব হতো না যদি সেটি এখনো আগের মত নিষিদ্ধ থাকতো। কখনো জানতেই পারতামনা চীনের রাজবংশের সম্রাটরা এখানে কীধরণের বিলাসবহুল জীবনযাপন উপভোগ করেছেন! সত্যি আমি ভাগ্যবান এমন একটি ঐতিহাসিক স্থান ঘুরে দেখার সুযোগ পেয়ে।
চীনে একটি কথা
প্রচলিত রয়েছে, কেউ যদি
চীন দেশে যায়
এবং তিনি যদি
গ্রেটওয়াল-এ
যেতে না
পারেন কিংবা উঠতে না
পারেন তবে
তার চীন
ভ্রমণ পূর্ণ হয়না! এই কথাটির যথার্থ প্রমাণ পেয়েছি আমি। এটি পৃথিবীর এমন একটি সত্যিকারের গ্রেটওয়াল বা মানুষের তৈরি বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্থাপনা যেখানে না গেলে এই বিশাল মহাপ্রাচীরের অপার সৌন্দর্যের রহস্য কেউ বুঝাতে পারবে না। আমি স্কুলে পড়াকালীন সময়ে পাঠ্য বই-এ পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যের একটি চীনের এই মহাপ্রচীরের গল্প পড়েছিলাম। এ সম্পর্কে তেমন কিছু মনে না থাকলেও চীনের মহাপ্রচীরের নামটি আর তার আংশিক আবছা ছবি ছাপানো ছিলো বই-এ। তখন ভেবেছি এটা কী, কেমন এই প্রচীর? কেন এত নাম হল এই প্রাচীরের? কেন এটিকে পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের একটি বলা হলো? সেটা ২০১৩ সালের অক্টোবরে বুঝতে পারলাম যখন আমি এই Great Wall-এর সিড়ি গুলো ধাপে ধাপে একের পর এক অতিক্রম করে উপরে উঠে যাচ্ছিলাম। এই মহাপ্রাচীরটি বিশ্ব ঐতিহ্যের একটি অংশ হওয়ার পাশাপাশি এটিকে চীনের জাতীয় প্রতীক হিসাবেও বলা হয়। গ্রেট ওয়াল সে এক বিশাল প্রাচীর যার সর্বোচ্চ উপরে উঠা সহজ ব্যাপর নয়। এক একটি সিড়ির ধাপ বেয়ে উঠে আপনাকে হাঁফাতে হবে। উপরে উঠতে উঠতে আপনি খুবই দূর্বল হয়ে পড়বেন কিন্তু মজার এই যে, উপরে ওঠার পর নিচে আর চারপাশে যখন তাকাবেন তখন আপনি বুঝবেন যেন আকাশে শূন্যের মধ্যে ভেসে আছেন। তখন নিমিশেই ভুলে যাবেন কষ্টের কথা। সবকিছু মিলে সে যেন আলাদীনের রূপকথার গল্পের মত এক আশ্চর্য অনুভূতি তৈরী হবে। অসাধারণ অপরূপ সেই দৃশ্য। এখানে না এলে এত কাছ থেকে ছুয়ে না দেখলে এর অপার সৌন্দর্য কেউ বুঝতে পারবে না। স্বপ্নময় চীনে গিয়ে আমার জীবন সত্যি সফল আর স্বার্থক হয়েছিল এই চীনের মহাপ্রাচীর বা Great Wall-এ উঠে। চীনা ভাষায় এ প্রাচীরটিকে বলা হয় ছাংছোং। ছাংছোং- এর আভিধানিক শব্দ হচ্ছে দীর্ঘ দেয়াল। এই মহাপ্রাচীরের যেমন এখন অনেক খ্যাতি, গুণ এবং সুখানুভূতির তৃপ্তি রয়েছে তেমনি এটি তৈরীর পেছনেও রয়েছে অনেক কঠিন ও নির্মম ইতিহাস।
খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে, মানে আজ থেকে প্রায় ২ হাজার ৮০০ বছর আগে এই মহাপ্রাচীর নির্মাণের কাজ শুরু হয়। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রাজা এই প্রাচীরের বিভিন্ন অংশ তৈরি করেন। কয়েকটি প্রজন্মে ভাগ হয়ে সবশেষে আজকের মহাপ্রাচীরের মূলভিত্তি রচিত হয় ১৫৬৯-১৫৭৫ এর সময়ে। এটা কোন ছোটখাটো দেয়াল নয়, এ প্রাচীর ভীষণ উঁচু এবং চওড়া। ইট-পাথর দিয়ে তৈরি প্রায় ৫ থেকে ৮ মিটার উঁচু এই প্রাচীরটি কোথাও পাহাড়, কোথাও সমতল, কোথাও গেছে মরুভূমির ওপর দিয়ে। নয় হাজার কিলোমিটারের অধিক লম্বা এই প্রাচীরটি চীনের সাংহাই পাস থেকে শুরু হয়ে লোপনুর নামক স্থানে শেষ হয়েছে।
চীনের ভৌগলিক উত্তর ও দক্ষিণ দিকের সীমান্তে তৎকালীন মঙ্গোলিয়ান আর যাযাবর মঙ্গোলিয়ানদের বসবাস ছিল। মঙ্গোলিয়ানরা ২ হাজার বছর ধরে চীনাদের বসতবাড়িতে হানা দিত, আগুন ধরিয়ে দিত, লুট করত ফসল, খাবার আর টাকাপয়সা।
১৫৫০ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন মিং সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল বেইজিং। আর যাযাবর মঙ্গোলিয়ান জাতির নেতা ছিলেন চেঙ্গিস খান। চীনা শান্ত ভূখন্ডে হুট করে একদিন অস্ত্র-সজ্জিত মঙ্গোলিয়ানরা আক্রমন করে। রাজধানীর ৭০ মাইল জুড়ে জনপদে চলে গণহত্যা, লুন্ঠন আর যুদ্ধবন্দী করার নির্মমতা। এটি ছিল মঙ্গোলিয়ানদের সবথেকে ভয়াভহ আক্রমণ। তখন মঙ্গোলিয়ানরা একজন চীন সম্রাটকে বন্দী করে তাদের দাবী পেশ করে যে, তাদের সাথে রাজনৈতিক ক্ষেত্র স্থাপন করতে হবে ও ব্যবসাবাণিজ্য করতে হবে। যাতে এর মাধ্যেমে তারাও তাদের দেশ উন্নত করতে পারবে। প্রায় এক মাস এই ধংস্বযজ্ঞ চালিয়ে ১৫ অক্টোবর ১৫৫০ খ্রিস্টাব্দে মঙ্গোলিয়ানরা ফিরে যায় তাদের নিজেদের জায়গায়। বেইজিং এর যুদ্ধমন্ত্রীকে তার ব্যর্থতা ও যুদ্ধ না করে পালানোর অপরাধে শিরশ্ছেদ করা হয় রাজপ্রাসাদে সবার সামনে। সেই সময় দেখা যায় নতুন চৌকস সেনা অফিসার ছি চি গুয়াং। সে এই ধংস্বজজ্ঞ দেখে মঙ্গোলীয়ানদের রুখে দাড়ানোর পরিকল্পনা শুরু করে। ২ হাজার বছর ধরে বারে বারে এই মঙ্গোলিয়ান জাতি আক্রমণ করে আসছিল চীনের মূল ভূখন্ডের উত্তর দিকের কয়েক হাজার মাইল এলাকায়, সেই এলাকাতে সে এক স্থায়ী সমাধানের ধারণা আনে যা সম্রাটের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না। পরে তাকে পাঠানো হয় জাপানীজদের প্রতিহত করতে। ছি চি গুয়াং তার নিজস্ব সৈন্যবাহিনী প্রতিষ্ঠা করেন এবং জাপানীজদের সাথে যুদ্ধে জয়লাভ করেন। এর ১৭ বছর পর ছি চি গুয়াং কে সেনা-প্রধান করা হয়। ঠিক সেই সময় আবার মঙ্গোলিয়ানদের আক্রমণের আশংকা তৈরী হয়। তখন সম্রাটকে দ্বিতীয়বার মঙ্গোলিয়ানদের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য মহাপ্রাচীর নির্মাণের পরিকল্পনার কথা বলা হয়। কিন্তু বিভিন্ন বাধার পরেও অবশেষে সম্রাট তাকে মহাপ্রাচীর তৈরীর অনুমতি দেন।
প্রায় ২০ হাজার মানুষ নিয়ে ১৫৬৯ খ্রিস্টাব্দে এর নির্মান কাজ শুরু করেন সেনা-প্রধান ছি চি গুয়াং। প্রাথমিকভাবে মূল অংশের প্রাচীর নির্মানের জন্য ৫ বছর সময় দেয়া হয় সেনাপ্রধান কে। ইট পাথর আর পোড়ামাটি দিয়ে শুরু হয় প্রাচীর নির্মানের কাজ। একেকটি ইটের ওজন ছিল প্রায় ২০ কেজি। মানুষ দিয়ে পাহাড়ের গায়ে উঠিয়ে নিয়ে ইট পথর একটার পর একটা গেথে তৈরী করা হত প্রতিটি দুর্গ এবং দেয়াল। কয়েকশ গজ পর পর একটি করে পর্যবেক্ষণ টাওয়ার স্থাপনের পরিকল্পনা সহ এভাবে কয়েক হাজার টাওয়ার এর নির্মাণ মোটেই সহজ ছিল না। কিন্তু পরিকল্পনাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে কাজটাকে গুণগত দিক থেকে নিশ্ছিদ্র করা হয়। ৩০ ফুট উচু এবং ১০ ফুট প্রশস্ত দেয়াল। প্রতিটি দেয়ালের নকশা নিশ্চিত করা হয় যেন তা পাহাড়ের চূড়ার উপর দিয়ে তৈরী হয়। এটা ছিল একটা বিশাল সামরিক পরিকল্পনা। ফলে রাজ্যের মোট আয়ের ৭৫ ভাগ নি:শেষ হচ্ছিল এই মহাপ্রাচীর প্রকল্পে। কিন্তু এই কঠোর পরিশ্রমের কারণে ছড়িয়ে পড়ে অপুষ্টি, চর্মরোগ, মানসিক অবসাদ সহ আরও নানা রোগ। সৈনিকরা বছর ধরে পরিবারের সাথে দেখা না করে কঠিন প্রকল্প শেষ করতে কাজ করছিল। সেখানে বিনোদন বলতে কিছুই ছিল না। ছিল শুধু কঠিন পরিশ্রম। এরমধ্যে অনেকে অসুস্থ হয়ে মারা যেতো। মরে যাওয়া সৈনিককে অন্য সৈন্যরা সহোদরের মতই ভেবে নিয়ে শেষকৃত্য শেষ করত। পাতায় বোনা চাটাইয়ে তাদের মৃতদেহ সমাধিস্থ হত এই মহাপ্রাচীরের আশেপাশেই। আর এভাবেই ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে অনেক কঠিন পরিশ্রমের পর প্রাচীরের প্রথম ধাপের কাজ শেষ হয় এবং মার্চ মাসের কোন একদিন যাযাবর মঙ্গলিয়ানরা আবারও আক্রমণ করে বসল প্রাচীর দ্বারা ঘেরা উত্তর প্রান্তে। কিন্তু এবার তারা সফল হতে পারলো না। প্রাচীরের পিছনের সামরিক পরিকল্পনা কাজে দিল এবং যাযাবররা পালিয়ে গেল।
মহাপ্রাচীর নির্মানের শেষের দিকে জেনারেল ছি চি গুয়াং কে সরাতে ষড়যন্ত্র শুরু হল বেইজিং এ। নতুন চীনা সম্রাট জেনারেল এর বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অর্থ আত্মসাত ও সম্রাটকে খুন করে সিংহাসন দখলের মিথ্যা অভিযোগ প্রয়োগ করে এবং তাকে বরখাস্ত করা হয়। তারপর বছরখানেকের মধ্যে খুন করা হয় জেনারেল ছি চি গুয়াং কে। মহাপ্রাচীরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়কালের সৈনিক নেতা হারিয়ে গেলেন নিমিষেই।
মহাপ্রাচীর ছাড়াও আমি গিয়েছি Temple of Haven পার্ক এবং 789 নামের একটি আর্ট কেন্দ্রে। যেখানে চমৎকার চমৎকার আর্ট দেখে আমি খুবই অভিভূত হয়েছি। গিয়েছিলাম দক্ষিণ চীনের বৈশিষ্ট্যময় খাবারের জন্য বিখ্যাত চিন দিং স্যুয়ান রেস্টুরেন্ট ও Silk Market-এ। আমরা একটা গ্রামেও গিয়েছিলাম তার নাম ছিল সি ওয়াং। গ্রামটির পরিবেশ খুবই সুন্দর ছিল। ঐ গ্রামের কয়েকটি বাড়ী ছিল যা চোখের নজর মুহূর্তেই কেড়ে নেয়। তার কারণ হল বাড়ির দরজায় আসবাবপত্র বিশেষ করে খাবারের টেবিল, সোফা, পালঙ্ক, টেবিল টেনিস খেলার ব্যবস্থা সহ অভূতপূর্ব সব ডিজাইন রয়েছে। যা ড্রাগনের, হাতি, বাঘ, ও অতীত দিনের নানান ঘটনার কথা সে সব ডিজাইনে অঙ্কিত রয়েছে। যা দেখার মত। নিজ চোখে না দেখলে বুঝানো যাবেনা সে সব মুহূর্তের কথা। আরেকদিন আমরা ইয়ং হো কং Tama Trample–এ গিয়েছিলাম। এখানে বিশাল কারুকার্জের বড় একটি বৌদ্ধ মূর্তি দেখেছি যা চারতলা ভবনের সম মানের উঁচু। আমি খুবই আশ্চর্যান্বিত হয়েছি। কারণ এত বড় মূর্তি এর আগে কখনো আমি দেখিনি।
পৃথিবীজুড়ে চীনা খাবারের স্বাদ ও চাহিদার শেষ নেয়। বেশির ভাগ লোকই চীনা খাবারের স্বাদ নিতে উন্মুখ হয়ে থাকেন। আমিও তার বেতিক্রম নয়। চীনা খাবার আমার বেশ প্রিয়। এরমধ্যে চীন ভ্রমণে গিয়ে চীনা খাবার যদি প্রাণ ভরে না খায় তাহলে হয়? প্রতিদিন খেয়েছি নানা রকম সুস্বাধু খাবার তবে এখানে চীনের স্পেশাল একটি খাবারের কথা না বললে নয়। আর তা হচ্ছে “বেইজিং ডাক”। হ্যাঁ, চীন ভ্রমণের সময় একদিন আমাদের চীনের ডাক খাওয়ানো হয়েছিল। চীনের ডাক সেটা চীনের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং নামকরা খাবার বলে পরিচিত। শুনেছি, কেউ চীন দেশে বেড়াতে গিয়ে চীনের ডাক বা বেইজিং ডাক যদি না খায় তবে তার চীন দেশে বেড়ানো অসম্পূর্ণ থেকে যায়। চীনের ডাক, সে এক অসাধারণ, চমৎকার, তৃপ্তিময়, খুবই মজার খাবার। এ অসাধারণ খাবার না খেলে বুঝতে পারবেন না তার মজাটা। সব ভেঙ্গে বলব না, তার আকর্ষণটা সবার কাছে থেকে যাক। আপনিও কখনো চীনে গেলে অবশ্যয় মনে করে “বেইজিং ডাক” খেয়ে এর অমৃত স্বাদ উপভোগ করবেন।
সিআরআই-এর কল্যাণে আমার স্বপ্নের চীন দেশ নিজ চোখে দেখতে পেয়ে সত্যি আমি গর্বিত, আনন্দিত ও কৃতজ্ঞ। এই চীন দেশ এবং সে দেশের মানুষের সাথে আমার যে গভীর আত্নার সম্পর্ক ও মধুর ভালোবাসা তৈরী হয়েছে তা কখনো ভুলার নয়। আমি বিশেষ ভাবে কৃতজ্ঞ সিআরআই বাংলা বিভাগের কর্মী ছাই ইউয়ে (মুক্তা) আপুর কাছে। কারণ, চীন ভ্রমণের সময় তিনিই ছিলেন আমার সফর সঙ্গী, আপনজন। তিনি যেমন দেখতে সুন্দরী তেমন তার মিষ্টিকন্ঠস্বর ঠিক যেন নীল আকাশের হলুদ পরী। মুক্তার কন্ঠ রেডিও-তে আমি নিয়মিত শুনলেও বাস্তবে তার সাথে আমার প্রথম দেখা হয় চীনে। চীন ভ্রমণকালে মাত্র কয়দিনে মুক্তা যেন আমার খুব কাছের বন্ধু হয়ে গিয়েছিলেন। একবারেও মনে হয়নি সে একজন চৈনিক আর আমি বাঙালি! দুজনের দেশ যোজন যোজন মাইল দূরে হলেও কখনো সেটা দূরের মনে হয়নি।
সবশেষে বলতে চাই এই চীন আন্তর্জাতিক বেতার আমার জ্ঞানবৃদ্ধির খোরাক যোগানোর পাশাপাশি বিনোদন দেওয়া সহ আমার ব্যক্তি জীবন পাল্টে দিয়েছে। বর্ণিল রঙে স্বপ্নময় সুখের সংসার ঘড়ে দিয়েছে। আমাকে দিয়েছে একটি নতুন ঠিকানা। যে ঠিকানা চির জীবনের। যার মাধ্যমে এবং যার উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় আমার চীন বেতার শোনা শেষ পর্যন্ত তার সাথেই আমার বিয়ে হয়েছে। এজন্য আমরা চীন
আন্তর্জাতিক বেতারের কাছে কৃতজ্ঞ। বেতার সেতুবন্ধনের ছোয়ায় আমরা শ্রোতা পরিচয় থেকে স্বামী-স্ত্রী (দম্পতি) পরিচয়ে পরিচিত হলাম। এই
পরিচয় আমাদের জন্য সত্যি মধুর এবং
রোমাঞ্চকর! এখানে উল্লেখ করা
প্রয়োজন চীন
আন্তর্জাতিক বেতারের সাবেক বিদেশী ভাষা বিশেষজ্ঞ মহিউদ্দীন তাহের ভাই
আমাদেরকে “সিআরআই শ্রোতা দম্পতি” হিসেবে উপাধি দিয়েছেন। সিআরআই-এর
বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও তিনি আমাদের এভাবে পরিচয় করিয়ে দিতেন অন্যদের সাথে। আজ
এই সুযোগে তাহের ভাইকেও ধন্যবাদ এবং
কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। বর্তমানে আমাদের একটি পুত্র সন্তান রয়েছে। নাম
লাবীব ইকবাল, বয়স ৪
বছর। তার
সুন্দর একটি চীনা নামও রয়েছে- লেই য়ি বো (Lei yi bo)! আর এই
সুন্দর চীনা নামটি রেখেছেন চীন
আন্তর্জাতিক বেতার বাংলা বিভাগের বর্ষীয়ান কর্মী সাবেক পরিচালক মাদাম চুং
শাওলি! তার প্রতিও আমরা অশেষ কৃতজ্ঞ। আমাদের ছেলেও এখন
আমাদের সাথে চীন
বেতারের অনুষ্ঠান শোনে তবে
ঐভাবে বুঝতে পারেনা। আমরা এখন
থেকে তাকে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছি। একসময় আমরা বুড়-বুড়ি হয়ে
যাবো কিন্তু সে
তখন তরুণ যুবক হয়ে
আমাদের চীন
বেতারের গল্প বলবে এবং
আমরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে
শুনবো! ইতিমধ্যে আমাদের ছেলে চীন
বেতারের দুটি বড়
অনুষ্ঠানে অংশ
নিয়েছে। একটি ছিল
২০১৫ সালের নভেম্বরে ঢাকায় প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁ হোটেলে সিআরআই কর্তৃক আয়োজিত দ্য
ফ্লেবার্স অব
চায়না খাদ্য উৎসবে অংশগ্রহণ। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে চীনের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত
বিশিষ্ট শেফবৃন্দ লাবীবকে কোলে নিয়ে বেশ
আনন্দ করেছেন এবং
সেলফি তুলেছেন। পরে
সে বুফেতে কয়েকটি ঐতিহ্যবাহী চীনা খাবার খেয়ে তার
স্বাদ গ্রহণ করে। সেদিন লাবীব ইকবাল সিআরআই বাংলা বিভাগের উপ-পরিচালক ছাও
ইয়ান হুয়া সুবর্ণার সাথে প্রথম ছবি
তোলে। এবছর ১১
মে ঢাকায় সিআরআই শ্রোতা সমাবেশের আয়োজন করা
হয়। সিআরআই বাংলা বিভাগের পরিচালক মাদাম ইউ কোয়াং ইউয়ে (আনন্দী) এবং সিআরআই কনফুসিয়াস ক্লাসরুমের পরিচালক খোং চিয়া চিয়া (প্রেমা) ঐ অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। আমাদের সাথে ছেলে লাবীব ইকবালও সে অনুষ্ঠানে যোগ দেয়। মাদাম ইউ তাকে অনেক আদর করেন এবং কোলে নিয়ে ছবি তুলেন। আর এভাবেই সিআরআই ও চীনের সাথে আমাদের পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় হয়ে উঠছে। আমাদের আশা ছেলে লাবীব ইকবাল আগামীতে বড় হয়ে চীনে লেখা-পড়া করে চীনের ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে উচ্চতর জ্ঞান লাভ করে দু-দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক উন্নয়নে অনন্য ভূমিকা পালন করুক। ফলে এখন থেকে তার চীন সম্পর্কে জানার আঁতুড়ঘর বা সূতিকাগার হয়ে উঠুক আমার প্রিয় চীন আন্তর্জাতিক বেতার (সিআরআই)।
এই সেই সিআরআই যার কথা, সুর, আনন্দ ভালোবাসায় ভরে যায় আমাদের হৃদয়। শুধু তাই নয় হৃদয়ের ব্যাথা, বেদনা, দু:খ ও বার্ধক্য ভুলিয়ে দিয়ে আগামী নতুন সুন্দর দিনের জন্য নতুন ভাবে মনকে গড়ে তুলতে সহায়তা করে। সিআরআই অনাবিল অনন্ত। তাইতো সে বড় বড় মনীষী, কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী সহ আরো অনেক অসাধারণ মানুষের জীবনী তুলে ধরেছে আর যা শুনে শ্রোতাদের নতুন ভাবে বাঁচতে, নতুন করে ভাবতে অদম্য সাহস জুগিয়েছে। যার তুলনা হয়না। চীন আন্তর্জাতিক বেতার বাংলা বিভাগ আগামী ১ জানুয়ারি ২০১৯ সালে তার ৫০ বছর পূর্ণ করবে। দীর্ঘ এই পথচলায় অনুষ্ঠানের কাঠামো, বেতারের কর্মী এবং শ্রোতাদের মধ্যে অনেক কিছু পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংযোজন, বিয়োজন হয়েছে সময়ের তালে তালে। তেমনি আগামী ১০০ বছর পূর্ণ করার লক্ষ্য নিয়ে নিত্য নতুন ও সময়োপযোগী অনুষ্ঠান তৈরী এবং শ্রোতাদের মন জয় করার প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে যাক আমরা সেই প্রত্যাশা করি। আমরা প্রাণ খুলে গেয়ে উঠতে চাই-
সিআরআই বাংলার প্রতিষ্ঠার পঞ্চাশ
শ্রোতাদের ঘরে ঘরে আনন্দের উচ্ছাস।
আজীবন শুনব সিআরআই বাংলার গান
গৌরবে, সৌরভে ভরে উঠবে সকলের প্রাণ।।
_________________
তাছলিমা আক্তার লিমা
ভাইস চেয়ারম্যান
সিআরআই- সাউথ এশিয়া রেডিও ক্লাব
বাড়ী- ৩৩৬, সেকশন- ৭, রোড- ২,
মিরপুর, ঢাকা- ১২১৬, বাংলাদেশ।
এই গল্পের প্রথম অংশ পড়তে হলে এখানে ক্লিক করুন<<<<<<<
চীন
আন্তর্জাতিক বেতার বাংলা
বিভাগের ৫০ বছর
পূর্তি উপলক্ষে বিশেষ
স্মৃতিচারণ:
“আমার
স্বপ্নময় সুখের সংসার
ঘড়ে দিয়েছে CRI –তাছলিমা আক্তার লিমা”
এই গল্প সম্পর্কিত ছবি দেখতে এই অংশে ক্লিক করুন.......
No comments:
Post a Comment